ছাবের আহমদ চৌধুরী
আমাদের মাঝে প্রতি বৎসর আসে নববর্ষ। চীন,জাপান, ফ্রান্স, বাংলাদেশ, ইরান সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নববর্ষ উদ্যাপন করা হয়, সবাই নিজ নিজ দেশে নববর্ষ পালন করে থাকে। নানান সমারোহে আমরা পালন করে থাকি বাংলা নববর্ষ উৎসব। বিগত দিনের ব্যাথা-বেদনার অবসান ঘটিয়ে, নতুন বৎসরের নতুন স্বপ্ন প্রত্যাশা করি। হতাশা ও নৈরাজ্যের হাত থেকে মুক্তি,মনের কালিমা ও চিত্তের ধৈন্যদশা থেকে মুক্তির প্রত্যাশা করি। পহেলা বৈশাখ এর শুভ দিনটিতে বাঙ্গালির ঘরে ঘরে আসে নতুন আনন্দ ও উদ্দীপনা। সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে ঘর সাজানো হয়, বিভিন্ন উপহার পাওয়া নতুন পোষাক পড়ে অনেকেই, পরস্পরের জন্য মঙ্গল কামনা, এই দিনের সামাজিক ভাবে প্রধান অঙ্গ হয়ে দাড়ায়।
আমাদের আনোয়ারার মামুরখাইন বাংলা বাজারে ইদ্রিস সওদাগরের একটি চায়ের দোকান ছিল। প্রতি বছর ঐ দোকানে হালখাতা উৎসব/পূণ্যাহ্ উৎসব উদ্যাপন করা হতো, সেইদিন ঐ দোকানে আলোকসজ্জা করে থাকে এবং সারাদিন মাইক বাজানো হয়।মাইক দিয়ে হালখাতার বকেয়া টাকা পরিশোধ করার জন্য বলা হয়। হালখাতা অনুষ্ঠানে আগতদের শুভেচ্ছা জানানো হয়। ঐদিন ছাগল জবেহ্ করে, নানরুটি ও গরম গরম পরটা দিয়ে অ্যাপায়ন করা হয়।অ্যাপায়ন শেষে বিগত দিনের হালখাতার বকেয়া পরিশোধ করা হয়।সেইদিন বেচাকিনা তেমন হয় না।দোকানের মালিকের পাশে থাকে সাজানো একটা থালা। বছরের শেষে বকেয়া পরিশোধের টাকাটা দিলেও ঐদিন সেই প্রসঙ্গে কোন কথা উঠে না। কাস্টমার ও দোকানির মধ্যে ব্যবসায়িক সর্ম্পকের শুভ সূচনা ঘটে পূণ্যাহ্ উৎসবের মধ্যে নিয়ে। তাই এখানে প্রাধান্য পায় সহানুভূতি ও আন্তরিকতার। নববর্ষের প্রথম দিন আমাদের আনোয়ারার তিশরী গ্রামে নিকুঞ্জু বড়–য়ার বৈশাখী মেলার খেলা হত, ঐ মেলায় তালপাতার বাশীর আওয়াজ, দোলনা চড়া, বিভিন্ন খেলনা, ভাউয়াল গান, লোক সংগীতের অনুষ্ঠান হত। আমরা কয়েকজন দলবেধে মেলায় যেতাম, আসার সময় তরমুজ, বাঙ্গী, খিরা, বিভিন্ন খাদ্য সামগ্রী কিনে নিয়ে আসতাম। বাংলা নববর্ষ আমাদের জীবনে একমাত্র সংস্কৃতির সার্বজনীন উৎসব।আমরা বাংঙ্গালি মুসলিমরা ঈদ উৎসব করি, হিন্দুরা দূর্গোৎসব, বৌদ্ধরা বৌদ্ধ পূর্ণিমা উৎসব, খিষ্টানেরা বড় দিনের উৎসব পালন করে। আসলে এইগুলো হল ধর্মীয় চেতনার উৎসব কিন্তু বাঙ্গলির জাতির সম্মিলিত একটি উৎসব তা হল বাংলা নববর্ষের বৈশাখী উৎসব। এছাড়া ঐদিন হাটে-বাজারে খোলা মাঠে দর্শনীয় স্থানে বসে বৈশাখী মেলা। নানা জাতের ফল-মূল, নানান রকম কুঠির শিল্প, মাটি, বাশ-বেত, ও কাঠের তৈরী বিভিন্ন জিনিসও খেলনা যেমন: হাতি,ঘোড়া, গাড়ি, ঢাক-ডোল, মুকোস ও বাতাসা কেনার ধুম পড়ে যায়। নগরদোলা, পুতুল নাচ, নৌকা বাইচ সহ বাঙ্গলির বিভিন্ন সাংস্কতির অনুষ্ঠান হয়ে থাকে।এছাড়াও মহিলাদের সাজ-সজ্জার সামগ্রী এবং লোকজ খাদ্যদ্রব্য চিড়া, মুড়ি, খৈ, বিভিন্ন প্রকার মিষ্টির বৈচিত্রময় সমারোহ থাকে বৈশাখী মেলায়। ১৯শতকের মাঝামাঝি সময়ে পূণ্যাহ্ উৎসব বাংলা নববর্ষের প্রথমদিন অথাৎ বৈশাখ মাসের ১ তারিখে নিয়মিতভাবে পালন হয়ে আসছে। ১৭৬৬সালে ইংরেজদের দেওয়ানী লাভের পর প্রথম পূণ্যাহ্ উৎসব অনুষ্ঠিত হয় মুরশিদাবাদে ইংরেজদের রাজনৈতিক আবাসস্থলে লর্ড ক্লাইভের মাধ্যমে। পহেলা নববর্ষের আমাদের সবচেয়ে শখের খাবার হচ্ছে ইলিশ দিয়ে পান্তা ভাত, বিভিন্ন ভর্তাও কাচা মরিচ। বর্তমানে ইলিশ মাছের দাম নাগালের বাইরে যাওয়ার কারণে আমরা মধ্যবিত্ত পরিবারের লোকেরা পান্তা ইলিশ খাওয়া থেকে বিরত থেকেছি।
উপসংহার: আমাদের এলাকার আনোয়ারা উপজেলার তিশরী গ্রামের বাবু নিকুঞ্জ বড়–য়ার বৈশাখী মেলার খেলা দেখা শেষে বাড়ি ফেরার পথে দেখলাম বিভিন্ন মালামাল যেমন: সাবান, মগ, থালা-বাসন, হারিকেন ও বিভিন্ন সামগ্রী সাজিয়ে লটারী খেলা চলতেছে। আমারও সামান্য টাকা ছিল, ঐ টাকা দিয়ে আমি লটারী কিনে মারলাম, কিন্তু ভাগ্যে কিছুই আসল না, তারপর মন খারাপ করে আমাদের গ্রামের বাড়ি ওষখাইনে চলে আসলাম।